নিজস্ব সংবাদদাতা , পূর্ব বর্ধমান- রায়বেঁশে অথবা রাইবেশে নৃত্য সম্পর্কে কেউ, কেউ বলে বীরভূম জেলাতেই নাকি প্রথম এর উৎপত্তি কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। আসলে এর উৎপত্তি হয়েছিলো মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ও খড়গ্রাম থানাঞ্চলে। তবে চর্চা, বিকাশ ও প্রকাশ সেইসব ক্ষেত্রে বীরভূমের নামই আগে আসে। রায়বেঁশে বা রাইবেশে উৎপত্তির একটা আঞ্চলিক ইতিহাস আছে। অনেক আগে থেকে শারীরিক কসরতমূলক কিছু নৃত্যভঙ্গি বঙ্গের নানা প্রান্তে প্রচলিত ছিলো এবং তা ছিলো রায়বেঁশের আগে থেকেই। এই নৃত্যশৈলীর মুল বৈশিষ্টই হলো, নর্তকরা ডানপায়ে ঘুঙুর পড়তো, ঘন্টা, ঢোল, করতালের ছন্দে ডানপায়ের ঘুঙুর সহকারে নৃত্য করতো আর সাথে হাতে থাকতো কখনও ধনুক, কখনও বর্ষা, কখনও বা তলোয়ার। হাতের কৌশলে অস্ত্র ব্যবহারের ভঙ্গি প্রদর্শন এর প্রধান আকর্ষণ। এই নাচে বাদ্যের তালে,তালে একই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হয়। বাদ্য ও নৃত্যের এই সম্মিলিত গতি ও ছন্দে রায়বেঁশে নাচের স্বতন্ত্র ও সৌন্দর্য বজায় থাকতো। বলা হতো লেঠেলরা নাকি যুদ্ধের ক্লান্তি দূর করতে এই নৃত্য করতো।
এই রায়বেঁশের উদ্ভব নিয়ে ইতিহাসে কিছু তথ্য পাওয়া যায় যেমন, দিল্লির মসনদে তখন আকবর বাদশাহ। সে সময় অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানাঞ্চলে ফতেসিং পরগনায় ফতে হাড়ি নামক এক স্বাধীনচেতা সামন্ত রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর সৈন্যসামন্ত, দুর্গ, গড় সবই ছিল, আর ছিল তাঁর হস্তীবাহিনী। তিনি দিল্লির শাসন মানতেন না। ওই সময়ে ফতেসিং পরগনা সংলগ্ন অধুনা খড়গ্রাম থানার শেরপুর নামক দুর্গে দুর্গরক্ষক ছিলেন ওসমান খান। তিনি ছিলেন সুলতানি শাসকদের প্রতিনিধি। এঁরাও দিল্লির শাসন মানতেন না। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মান সিংহকে আকবর এই অঞ্চলে পাঠান এদের দমন করে মুঘল শাসন কায়েম করার জন্য। মান সিংহের সঙ্গে আসেন তাঁর সহকারী সেনাধ্যক্ষ সবিতা রায় দীক্ষিত। তাঁর সঙ্গে ছিল দুর্ধর্ষ ভীল সৈন্যদল, অর্থাৎ ভল্ল বা বল্লমধারী যোদ্ধা। মান সিংহ ওসমান খান-কে পরাস্ত করে এই অঞ্চলে মুঘল শাসন কায়েম করেন। সবিতা রায় দীক্ষিত মান সিংহের নির্দেশে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মুণ্ডমালা নামক স্থানে ফতে হাড়ি রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেন। পুরস্কার স্বরূপ দিল্লির বাদশাহের অনুমতি নিয়ে তাঁকে ফতেসিং পরগনার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। গড় নির্মাণ করে তিনি এখানে থেকে যান। জেমো-বাঘডাঙার রাজপরিবার সবিতা রায়ের উত্তরাধিকারী। রাজস্থান থেকে আগত ভল্লধারী যোদ্ধাবৃন্দও বাধ্য হয়ে এখানে থেকে যান। তাঁরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও চাষ-আবাদের কাজ জানতেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা লেঠেল, পাইক-বরকন্দাজের জীবিকা গ্রহণ করেন। অনেকে আবার লুঠতরাজও করতেন।
এই যোদ্ধারা জমিদারদের লেঠেল হিসেবে বাৎসরিক খাজনা আদায়ের সময় থাকতেন। ঘাঘরা পরে নৃত্যছন্দে বাদ্যভাণ্ডের তালে তালে তাঁরা যেতেন। দস্যুদলের আক্রমণ হলে তাঁরা বীরদর্পে ঢাল-তরোয়াল-বল্লম-লাঠি নিয়ে প্রতিহত করতেন। আগেকার দিনে বিয়ে পালকি সহযোগে হেঁটে হেঁটে যেত। সেই সময় দস্যু ডাকাত দল যে কোনো সময় হানা দিত সেই জন্য বিয়ের বরযাত্রীর সহিত কিছু আগে ও শেষে নৃত্য করতে,করতে যেত এই রায়বেঁশের দল। এরা এক এক জন ১০ থেকে ১৫ জন ডাকাতকে একা প্রতিরোধ করতে পারতো। রবীন্দ্রনাথ ছড়া কেটেছিলেন “রায়বেশে নাচ নাচের ঝোঁকে মাথায় মারলে গাঁট্টা / শশুর কাঁদে মেয়ের শোকে বর হেসে কয় ঠাট্টা”
যাইহোক এরাই পাশাপাশি বসবাসকারী হাড়ি, বাগদি, ডোম, বায়েনদের নিয়ে রায়বেঁশে দল গঠন করেন। রায়বাঁশ থেকে রায়বেঁশে নামের উদ্ভব বলে অনেকে মনে করেন। রাইবেশ (নারী বেশ) থেকে রাইবেশের উদ্ভব কথাটিও বলা যেতে পারে। এই ভল্লা জনগোষ্ঠীর বসতিকেন্দ্র সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাইবেশে দলগুলির সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলিই তাদের বিকাশকেন্দ্র। এরা প্রধানত গ্রাম্য বিয়েতে অংশ নিয়ে জীবিকা চালান। ইদানীং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এরা বহু অনুদান পাচ্ছেন ও দেশের নানা স্থানে রাইবেশে প্রদর্শন করছেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে গুরুসদয় দত্ত মশাই বীরভূমের জেলা শাসক হিসেবে এসে রাইবেশের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময় ব্রিটিশ সরকার ভল্লাদের অপরাধ প্রবণ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই অভিশাপ থেকে তিনি তাঁদের মুক্তি দেন ও জীবনের মূল স্রোতে নিয়ে আসেন। রাইবেশে নৃত্যকেও পুনরুজ্জীবিত করেন। এই নৃত্যশৈলীর সহায়তায় স্বদেশ হিতৈষণা ও সমাজসেবাকে একীভূত করে তিনি একটি অসাধারণ নৃত্যশৈলী উদ্ভাবন করেন, যা আজও ব্রতচারী হিসেবে সগর্বে প্রচারিত।
আজও মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থানার রতনপুর গ্রামে নবদয় রায়বেঁশে সমগ্র ভারতবর্ষে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠিত করে আছে। রায়বেঁশে লোকনৃত্য নানা উত্থানপতনের মধ্যে টিকে আছে আজও। সত্তরের দশকে মুর্শিদাবাদে এই নৃত্য প্রায় বিলুপ্তির পথে গেলেও এখন লোকায়ত শিল্পী সংসদ তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন। তাই এখনও কোনো কোনো অনুষ্ঠানে এই রায়বেঁশে নৃত্য ভঙ্গি ক্রীড়াকৌশলের মাধ্যমে সবাইকে আনন্দিত করে তোলে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের শীতেন্দু চক্রবর্তী এই বিলুপ্ত প্রায় শিল্প বা জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আজও, ২৫০ জনের উপর শিক্ষার্থী নিয়ে ৪০ জনের উপর শিক্ষক তৈরী করেছেন তিনি নিজে হাতে। বর্তমানে তার দল দেশ বিদেশের নানা মঞ্চ মাতিয়ে উজ্বল করছে পূর্ব বর্ধমান-এর নাম।

২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এ সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা এবং ইংলিশ খবর পড়ুন ২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এর ওয়েবসাইটে। নিয়মিত খবরে থাকতে লাইক করুন ফেসবুকে ও ফলো করুন টুইটারে।
‘রঙ’ ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা ‘খাচ্ছে’? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম ‘সংবাদ’! ‘ব্রেকিং’ আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে ‘রঙ’ লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে ‘ফেক’ তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই ‘ফ্রি’ নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।
Discussion about this post