পৃথা মন্ডল: পাড়ার লোকে ছেলেটাকে দেখলে হাসাহাসি করে। দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি তাকে। আত্মীয়-স্বজনরাও মা-বাবাকে কটু কথা বলে। তবুও হার মানেনি ছেলেটা। অদম্য জেদ ছিল তার মনে, আর ছিল সাহস। হার মানেনি লড়াই করে গিয়েছে সকলেয সাথে এই সমাজের সাথে। হ্যাঁ, লড়াই। লড়াইটা আমাদের সকলকেই জীবনে কম বেশি করতে হয় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত, প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু আমি এখন যার কথা বলবো তার গল্পটা একটু হলেও আমাদের থেকে আলাদা।
‘পুরুষ’ এই শব্দেটার মধ্যে যেন কেমন একটা গম্ভীর ভাব আছে। হয়তো আছে তাই জন্য তো আমাদের এই সমাজ সহজ জিনিস গুলোকে এত কঠিন করে দেখে। দেব বড়ুয়া যাকে হয়তো স্যোশাল মিডিয়ায় আমরা অনেকেই চিনে থাকি এবং দেখেছিও আজ আমি তার কথা বলবো, তার লড়াইয়ের কথা বলবো। লড়াইটা ছিল নিজের সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। সাধারণের মধ্যে থেকে আজ নিজেকে অসাধারন করে তুলেছে সে। সমাজকে সকলকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছে সে, সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে অধিকারটা সকলের জন্য সমান। লড়াইয়ের সাফল্যটা সহজে আসে নি। ওই যে কথায় আছে না, ” একদিনে হবে না একদিন ঠিক হবে “, আজ সে প্রতিষ্ঠিত। আজ তাকে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ দেখছে চিনছে। হ্যাঁ, আমাদের সমাজে এরকম মানুষের প্রয়োজন যাদের হাত ধরে চিন্তাধারার বদল ঘটবে।
শারীরিক গঠন বা শরীরের দিক থেকে সে পুরুষ হলেও তার মনটা ছিল একজন নারী। আমি সেই সময়কার ঘটনা থেকে আজকের লেখাটা শুরু করছি যখন সমকামী বা গে কথাটার প্রচলন ছিল না সমাজে। তখন এই রকম ধরনের মানুষদের ছক্কা, হিজরা এসব নামে ডাকা হতো। এখনো সমাজের কিছু মানুষ তাদের এই নামে সম্বোধন করেন কিন্তু সময়ের কিছুটা হলেও পরিস্থিতি বদলেছে এমনকি কিছু মানুষের চিন্তাধারাও বদলেছে।
ছোটবেলা থেকেই সে অন্যরকম। ছেলেদের সাথে ক্রিকেট ফুটবল খেলার থেকে পুতুল খেলতে বেশি ভালবাসতে ছেলেটা। মেয়েদের সাথে মিশতে মেয়েদের মতো আচরন তার পছন্দের। কিন্তু ওই যে বললাম সমাজ, সমাজ তো আর এগুলো এত সহজে মানে না। সকলের আপত্তিটা এখানেই। তখন বোঝার ক্ষমতা হয়নি। আসলে সে নিজে আর সবার থেকে অন্যরকম সে তখন সেটা বুঝতে পারত না। তার এই আচরন আমি যে ভাবটা অনেকের আপত্তিকর কারণ ছিল। স্কুলে পাড়ার ছেলেরা তার সাথে খেলত না কথা বলত না এখন কি হিজরা ছক্কা হাফলেডিস এই ধরনের টিটকিরি থেকেও সে বাদ পড়েনি। আমার আত্মীয়-স্বজনের কথা তো বাদই দিলাম।
আরো পড়ুন Exclusive Interview Shreelagna Bandyopadhyay: বড়োপর্দায় শ্রীলগ্না
মাধ্যমিক পর্যন্ত বয়েজ স্কুলেই পড়াশোনা তার। কিন্তু স্কুল জীবনটা মোটেও তার কাছে খুব সুখের বা ভালো ছিল না। ক্লাস ফাইভ এর সেই ছোট্ট দেব বড়ুয়া যে নিজেই তখনও তার নিজেকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক সেই সময় থেকেই তার লড়াইটা শুরু। বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন এমনকি স্কুলের শিক্ষকদের থেকে টিটকিরি শুনতে বাদ পড়েনি তাই। শুধুমাত্র ক্লাসমেটরা তাকে নিয়ে মজা করবে বলে তার সাথে বিভিন্ন রকমের নোংরামি অসভ্যতামি করেছে। হ্যাঁ নোংরামিই বটে, সমবয়সী বন্ধু অর্থাৎ ক্লাসমেটদের মাথায় যদি এরকম দুষ্টু বুদ্ধি থাকে আমি সেগুলোকে নোংরামিই বলবো। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন ক্লাসভর্তি ষ্টুডেন্টদের সামনে তার ক্লাসমেটরা তার প্যান্ট খুলে নেয়, সেদিন ক্লাসরুমে প্রচণ্ডভাবে তাকে নিয়ে মজা করা হয়েছিল, হাসি ঠাট্টা করা হয়েছিল। আর সেই ছোট্ট ছেলেটা প্রচণ্ড অপমান নিয়ে লজ্জা নিয়ে বসে ছিল ক্লাসরুমের বেঞ্চের একটা কোণায়। তাকে সকলের থেকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছিল।
এই সমস্ত ঘটনা গুলোর জন্য একটা সময় সে নিজেকে সকলের থেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এমনকি পূজোর সময় মা বাবার সাথে ঠাকুর দেখতে যাওয়া ঘুরতে যাওয়াটাও তার কাছে একটা বড়ো সমস্যা হয়ে উঠেছিল। তার মা- বাবার সামনে তাকে টিটকারি দেওয়া হত তাকে নিয়ে মজা করা হত এগুলো অস্বস্তিকর কারণ ছিল তার কাছে। উপরন্তু মা – বাবা বাড়িতে এসে তাকেই দোষারোপ করতো এই পরিস্থিতির জন্য কারণ সে আর পাঁচটা ছেলের মতো কেন হতে পারে নি! এই চাপা কষ্টগুলো তাকে দিনের পর দিন তারা করে গিয়েছে। যার জন্য সে নিজেকে সবকিছুর থেকে সরিয়ে নিয়েছে আস্তে আস্তে। কিন্তু কতদিনই বা এগুলো সহ্য করে থাকা যায়! সব প্রতিকূলতাকে জয় করে একদিন ঘুরে দাড়াতেই হয় সকলকে ঠিক তেমনভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেব বড়ুয়া। অনেকটা প্রতিকূলতা অনেক সমস্যা স্কুল জীবনের খারাপ সময় থেকে বেরিয়ে একটা ভালো সময় পদার্পণ করা তার কলেজ জীবন থেকে।
আরো পড়ুন Exclusive Interview: স্টার জলসার ‘খুকুমনি হোমডেলিভারি’র Nayanika Sarkar
তখন সে নিজেকে বুঝতে জানতে শিখেছে, কলেজ জীবনটা যেন তার একটা নতুন জীবনের সূচনা। স্কুল জীবনের থেকে কলেজ জীবনটা তার কেটেছে অনেক ভালো। সেখানে সে বন্ধু-বান্ধবের থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছে। তার বন্ধু-বান্ধবরা তার পাশে থেকেছে, তাকে আশ্বাস দিয়েছে। কলেজ জীবন থেকে তার জীবনের অধ্যায় এর একটা নতুন ধাপ শুরু হয়েছে।
সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক হওয়ার পর আরো পাঁচজন মানুষের মতোই সেও চাকরিতে ঢুকে ছিল কিন্তু ওই যে সমস্যা একই ছোটবেলা থেকে পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের থেকে যেইরকম ট্রিটমেন্ট চেপে এসেছে চাকরি ক্ষেত্রে একই সমস্যা।
সেই টিটকারি, অফিসে তাকে নিয়ে মজা করা, তার কথা বলার ধরণ টা কে হুবহু নকল করা আরো কত রকম ভাবেই তাকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলা হয়েছে। তখনো বাড়ির লোকও সবকিছু সুস্থ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। কলেজ সূত্রে তার যোগাযোগ হয় একটি সংস্থার সাথে যেখানে তারই মতো আরো অনেক বন্ধু বান্ধবদের সাথে তার আলাপ হয়। পরিবারের সমস্যা ছিল সেখানেই তাকে বারণ সত্তেও সে কিন্তু নিজের মনের মতন চলেছে এমন কি আজও সে তার মনের কথাই শোনে। সে নিজে কি চাইছে তার মন কি চায় বিশেষ করে গুরুত্ব দিয়েছিল সে তার মনের উপর। সমাজের কটু কথা কে তুচ্ছ করে।
দিনের-পর-দিন মানসিক চাপটা সহ্য করাটা তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটা সময়ের পর হাঁফিয়ে উঠেছিল ছেলেটা। সবকিছু থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে অনেক অনেক দূরে। প্রায় চার পাঁচ মাস পর একটা দীর্ঘ সময় এরপর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি ঠিক হয় তারপর সে ফিরে আসে তার পরিবারের কাছে। তারপর আসে সোশ্যাল মিডিয়া। দেব বড়ুয়াকে সোশ্যাল মিডিয়াতে এখন কি না চেনে! একটা বিরাট লড়াইয়ের পর আছে জয়লাভ করেছে। তার নাচ এবং মডেলিং ক্যারিয়ার কে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। হ্যাঁ আমাদের জীবনে খারাপ ভালো দুই ধরনের মানুষ থাকে কিন্তু এই দেব বড়ুয়ার মতই খারাপটা কি উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয় ভালো কে সাথে নিয়ে। জয় হোক সকল দেব বড়ুয়ার।
আমরা মনে করি পুরুষ বা ছেলে মানেই একটা রাগী গুরু গম্ভীর ভাব হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। সমাজ এই পুরুষ চেহারাটাকে এঁকে রেখেছে। আমাদের সমাজে তো এখন অনেক এগিয়ে টেকনোলজির দিক দিয়ে হোক কিংবা মানসিকতার দিক দিয়ে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের উন্নত মস্তিষ্কের বড়াই করেও তারা উন্নত নয়। সাধারণ ব্যাপার গুলো মেনে নিতে তাদের খুব সমস্যা হয়। সেই জন্যই তো এই ধরণের মানুষগুলোকে তারা মেনে নিতে পারে না।
হোক না সে সমকামী, হোক না সে অন্য রকম, সে হোক নিজের মতো, সমাজের মতো নয়। তার মন যেমন সে বাইরে থেকেও তেমনি থাক। সে ও তো মানুষ তারও সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অধিকার আছে। তাই সকলের চিন্তাভাবনার বদনাম হোক, জীবন সুন্দর হোক। আরে হ্যাঁ, একটা কথা বলা হয়নি- ভারতবর্ষে কিন্তু সমকামিতা এখন কোন অপরাধ নয়।

২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এ সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা এবং ইংলিশ খবর পড়ুন ২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এর ওয়েবসাইটে। নিয়মিত খবরে থাকতে লাইক করুন ফেসবুকে ও ফলো করুন টুইটারে।
‘রঙ’ ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা ‘খাচ্ছে’? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম ‘সংবাদ’! ‘ব্রেকিং’ আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে ‘রঙ’ লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে ‘ফেক’ তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই ‘ফ্রি’ নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।
Discussion about this post