শ্রীজিৎ চট্টরাজ : চৈত্রের শেষ কয়েকটা দিন। বাংলা নববর্ষের প্রস্তুতি চলছে বাঙালির মনে। সঙ্গী ফটো জার্নালিস্ট বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে মধ্য কোলকাতার পার্কসার্কাস অঞ্চলের একটি হোটেলে পৌঁছলাম নির্ধারিত সময় তিনটেয়। শেষ দুপুরের সূর্যে তখনও তীব্র দহন। হোটেলের রিসেপশনে পৌঁছতে না পৌঁছতে চলে এলো গরম চায়ের কাপ। শেষ চুমুক দেওয়ার আগেই হালকা সাদা পোশাকে হাত জোড় করে উদীয়মান হলো মান্নত। সামান্য দেরিতে আসার জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। রিসেপশন ছেড়ে আমরা গিয়ে বসলাম লনের সোফায় । ওহ! আপনাদের তো বলাই হয়নি, আসল ব্যাপারটা। আমরা এসেছি মুম্বাইয়ের অভিনেত্রী মান্নত সোনি’র একটি সাক্ষাৎকার নিতে। মান্নত পাঞ্জাবের মেয়ে।
পেশাগত কারণে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। কলকাতায় সে এসেছে অবিনাশ রাউত পরিচালিত দেশের প্রথম ও টি টি প্ল্যাটফর্মের রিয়েলিটি শোয়ের প্রতিযোগীদের অডিশন নিতে। কোলকাতায় অডিশন অবশ্য সাক্ষাৎকারের আগের দিনই শেষ হয়েছে। সে সাক্ষাৎকার দিয়েই সন্ধের ফ্লাইট ধরে চলে যায় হায়দরাবাদ। সেখানে অনুষ্ঠানের শেষ পর্বের অডিশন। এর আগে অডিশন হয়েছে দিল্লি, মুম্বাই,ব্যাঙ্গালুরু ও আহমেদাবাদে।বিশ্বজিৎ যেহেতু সাক্ষাৎকারটা ভিডিওতে নেবে সে তাই প্রথামাফিক ব্যস্ত হয়ে গেলো সেট সাজাতে। আলোর ব্যাকরণগত কৌশল সামলাতে একটু সময় দরকার। সেই অবসরে মান্নতের সঙ্গে আলাপ পর্বটা একটু ঝালিয়ে নিলাম। মান্নতের বয়স যতটা তার চেয়ে শরীরী ভাষা যেন পরিণত মনে হলো। কিন্তু চঞ্চল। কপালের বিদ্রোহী চুলের গোছা সামলে ঠোঁটের কোণে একটা ছেলেমানুষী হাসি ধরে রেখে আমাকে সে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল, আমার প্রশ্ন বাণে কতটা তীক্ষ্ণতা থাকতে পারে। বিশ্বজিৎ সবুজ সংকেত দিতেই আমি শুরু করলাম।ক্যামেরার রোল শুরু।
- প্রশ্ন: বাংলার অগ্রিম নববর্ষের শুভেচ্ছা।
মান্নত: তাই নাকি? বাংলায় নববর্ষ? আপনাদের সবাইকে আমার অনেক শুভেচ্ছা।
- প্রশ্ন: কোলকাতায় তো এই প্রথম । বাংলা কথা বোঝেন?( প্রশ্নটা বাঙলাতেই করলাম)।
মান্নত: কয়েকদিন হলো কলকাতাতে এসেছি। বাংলা বলতে না পারলেও সব বুঝতে শিখে গেছি। দু একটা বাংলা বলতেও পারি।
- প্রশ্ন: হ্যাঁ । মুম্বাই থেকে বাংলায় এসে অনেকেই কয়েকটা বাংলা শিখে আসেন। আমি তোমাকে ভালোবাসি। রসগুল্লা খাবো। মিষ্টি দই খাবো।
মান্নত: না,না। আমি সত্যিই বাংলা ভাষা পছন্দ করি। আমি তো রসগুল্লার চেয়ে পছন্দ করি বাংলার চমচম। মুম্বাইতে কেউ কলকাতায় এলে বলে রাখতাম চমচম নিয়ে এসো। দারুণ। সুপার্ব। বাংলা ভাষা আমার খুব পছন্দ। এই দেখুন না, একটা বাংলা ফিল্মি গান আমি শিখে নিয়েছি।
- প্রশ্ন: কোন গান?
মান্নত: সেই যে ভুলবো না তোকে আমি ভুলতে পারবো না। দোহাই গানটা গেয়ে শোনাতে বলবেন না। আমি গাইতে পারি না। নিজের জন্য গাই।
- প্রশ্ন: বেশতো। শুনি। দুটো লাইন।
(বেশি অনুরোধ করতে হলো না। আধো আধো বাংলায় মান্নত শোনালেন সেই গান।)
আরো পড়ুন Actress Puja Saha Exclusive Interview: চেষ্টা করো সাফল্য আসবেই পূজা
- প্রশ্ন : দারুণ হয়েছে। বাংলার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছেন?
মান্নত: অল্প অল্প।
- প্রশ্ন: চলো,সরাসরি প্রশ্নে চলে যাই। শুনেছি,খুব ছোট বয়স থেকেই ফিল্ম, টিভিতে আসা। স্ট্রাগল তাহলে তো করতে হয়নি?
মান্নত: না আমার শুরুটা ফিল্ম বা সিরিয়াল দিয়ে হয়নি। বয়স তখন চার। টাটা স্টিলের একটা এ্যাড ফিল্মে প্রথম কাজ। কিছুই বুঝতাম না। ডিরেক্টর যেমন যেমন বলতেন, তেমনটা করতাম। তারপর থেকে টুকটাক এ্যাড ফিল্মে কাজ। আর স্ট্রাগল? সেটা জীবনের শুরু থেকেই। আমার মায়ের বাড়ি, অর্থাৎ মামার বাড়ি ছিল আর্থিক ভাবে দুর্বল। একসময় মা ও বাবার মধ্যে অশান্তি এমন হলো, বাবা আমাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। মাকে পারিবারিক হিংসার কবলে পড়তে হয়। আমরা তিন বোন। আমিই ছোট। মেজ বোনের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য প্রায় ছয় বছরের। পেটের জন্য মাকে অন্যের বাড়িতে বাসনও মাজতে হয়েছে। পরে মা একটা চায়ের দোকান খোলেন। আমি কাস্টমারদের চা পরিবেশন করতাম। বেশ মজা লাগতো। একসময় ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে একটা ছোট ধাবা খোলেন।বুঝুন,একজন মহিলার কি সাহস ।
- প্রশ্ন: তখনও জানতেন না, চা ওলা থেকে একদিন সেলিব্রেটি হওয়া যায়।
মান্নত: ( আমার ইঙ্গিত বুঝে হেসে উঠল) সত্যিই বুঝিনি, আজ আমি এখানে এসে পৌঁছতে পারবো। সবই ওপরওলার আশীর্বাদ। একসময় আমার দিদিমা বুঝলেন, তিন মেয়েকে সামলে ধাবা চালানো মায়ের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠছে। সেই সময় আমার মামা একটা ভালো কাজ পেয়ে বিদেশে। ঠিক হলো আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে মামার কাছে। মাকে ছেড়ে চলে যাবো ভেবে খুব কেঁদেছিলাম। মাও কেঁদেছিল। সত্যি বলতে কি, বোনেদের মধ্যে আমার সঙ্গেই মায়ের একটা বন্ডিং ছিল অন্যরকম। হয়তো সবার ছোট বলে। কিন্তু আমার মা বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে রাজি হতে বাধ্য হন। তবে একটি শর্ত জুড়ে দেন। ছুটিতে প্রত্যেক বছর আমাকে পাঞ্জাবে দেশের বাড়িতে পাঠাতে হবে। সেটাই হলো। যে কটা বছর আমি বাইরে ছিলাম, দেওয়ালির ছুটিতে বাড়ি আসতাম। সেই সময়ে কয়েকটা এ্যাড ফিল্মের কাজও করতাম। কয়েকবছর পর মা ছুটিতে যখন এলাম, খুব কান্নাকাটি করে বললেন, আমি চাই তুমি এমন কিছু করো,দেশের মানুষ যেন তোমায় চেনে।বুঝলাম ,মা প্রথাগত শিক্ষা নয়, তিনি চান গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে আমি যেন কিছু করি। সেদিন মাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করবো। কতোটা পেরেছি জানি না, তবে মায়ের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করছি,এটাই আমার তৃপ্তি।
- প্রশ্ন: তাহলে ফিল্মে কিভাবে এলে?
মান্নত: দেশে যখন ফিরলাম, আমার দিদিরা তখন কাজের মুম্বাই চলে এসেছে। আমিও চলে এলাম।জানতাম ভালো অভিনয় করতে হলে অভিনয়ের গ্রামার জানতে হবে। তাই ভর্তি হয়ে গেলাম এক নাটকের দলে। প্রথম একবছর শুধু সিনিয়রদের চা জল সাপ্লাই দিয়েছি। আর মহলার সময়ে বড়দের অভিনয় দেখেছি মন দিয়ে। একদিন সুযোগ এসে গেল। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত আর্ট কলেজ জে জে কলেজের মঞ্চে সুযোগ এলো অভিনয় করার।পাশাপাশি সুযোগ এলো রামায়ণ খ্যাত সাগর আর্টস ইন্টারন্যাশানাল এর ব্যানারে পৃথ্বীরাজ চৌহান , স্বামী নারায়ণ সিরিয়ালে অভিনয় করার।
- প্রশ্ন: সেসব দিনের স্মৃতি কিছু মনে আছে?
মান্নত: সে আবার থাকবে না। পৃথ্বীরাজ চৌহান ছবিতে আমার হাতে একটা তলোয়ার দেওয়া হয়েছিল। সিন টা ছিল,শত্রু আক্রমণ করেছে, সবাই শত্রুর মোকাবিলা করতে ছুটে আসছি। আমি ছুটে এলাম ঠিক, কিন্তু অসাবধানতায় আমার সহশিল্পী সিনিয়র আর্টিস্ট ভূপেন্দ্রজীর হাতে আঘাত করে ফেললাম। হাত কেটে রক্ত। সে এক বিশ্রী ব্যাপার।
আমি ভয়ে চুপ। দুচোখ ভেঙে কান্না। ছোট তো। ভয় হলো, পুলিশে ধরিয়ে দেবে নাতো? পরিচালক ও ভূপেন্দ্রজী আমার মনের অবস্থা বুঝে পিঠ চাপড়ে বললেন, টেক ইট ইজি। ইটস এ অ্যাকসিডেন্ট।আরেকটা ঘটনা মনে আছে। একটা দৃশ্যে আমার বেশ বড় ডায়লগ। ফ্রেম ইন করছি ঠিক মত। কিন্তু ডায়লগ ভুলে যাচ্ছি। অনেকগুলো এন জি হলো।একসময় পরিচালক ধৈর্য হারিয়ে শুটিংয়ের লাইট অফ করে দিলেন। বললেন, কোথা থেকে সব আনাড়ি চলে আসে অ্যাকটিং করতে। আমি যত না অপমানিত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। কেন ভুলে যাচ্ছি বার বার। এক ঘন্টা কাজ বন্ধ ছিল। সবাই ফ্লোর ছেড়ে চলে গিয়েছিল।আমি একমাত্র ফ্লোরে বসে মুখস্ত করেছি। মা একটু দূরে বসেছিলেন। তিনি একবারের জন্যও উঠে আসেননি। আমি একা সিচুয়েশন ফেস করেছি। দূর থেকে পরিচালক ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখছিলেন। তিনি এসে পিঠ চাপড়ে বললেন,তোমার হবে। আমার গালাগাল শুনেও ফ্লোর ছেড়ে চলে যাও নি। অন্য অভিভাবকের মত তোমার মাও এসে তোমাকে নিয়ে চলে যাননি। এটা প্রশংসার যোগ্য। একদিন তুমি নিশ্চয় সফল হবে।
- প্রশ্ন: তুমি তো জ্যোতিষ বিশ্বাস করো?
মান্নত; হ্যাঁ। করি। তবে নিজেকে বেশি বিশ্বাস করি।
- প্রশ্ন: ভবিষ্যত সম্পর্কে জ্যোতিষ কি বলেছেন?
মান্নত: ( হেসে) তাঁর বক্তব্য, আমি যতটা পজেটিভ, ঠিক আমি সফল হবো।
- প্রশ্ন; নিজের প্রতি যদি এত বিশ্বাস,তাহলে আলাদা আবার ব্যবসা করছো কেন? মনে কি একটা দ্বিধা আছে?
মান্নত; না। আসলে ছোট থেকে এত কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছি, যে জীবনে আর স্ট্রাগল ফেস করতে চাই না । আমাদের দেশে সিনে ওয়ার্ল্ড ইন্ডাস্ট্রি বললেও তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবনের প্রথম পনেরোটা বছর আমরা পড়াশুনোর জন্য খরচ করি। কেননা,জীবিকার জন্য শিক্ষা দরকার। কিন্তু সবাই কি পছন্দের কাজ পাই? এত বেকার। তেমন, যাঁরা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে কাজ করি, তাঁদের ভবিষ্যতও নিশ্চিত নয়। আমি আপনি এমন অনেক ভালো ভালো শিল্পীদের জানি, যাঁরা বহু কাজ করেছেন। কিন্তু সঞ্চয় করতে পারেননি। শেষ জীবনটা খুব কষ্টে কাটে। প্যান্ডেমিক সিচিউশনে কাজ ছিল না। অনেকের ঘরে রেশন ছিল না। তার জের এখনও চলছে। সুতরাং দ্বিতীয় একটা রোজগারের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
- প্রশ্ন: কিসের ব্যবসা করছ?
মান্নত: আমি যেহেতু গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে আছি, আমার মনে হয়েছে ফ্যাসেনেবল ড্রেস আইটেমের ব্যবসা আমার জন্য ঠিক হবে। অনলাইনে ব্যবসা। ভালই রেসপন্স পাচ্ছি।
- প্রশ্ন: পোশাকের ব্যবসা যখন, মডেলিং নিশ্চয়ই তুমিই করছো? অন্য মডেল নেওয়ার খরচ বেঁচে যাচ্ছে।
মান্নত: না,ব্যাপারটা এমন নয়। আমি এসো ক্ষেত্রে নতুনদের সুযোগ দিচ্ছি। মাঝে মাঝে যদি প্রয়োজন হয়,তখন মডেলিং আমি করি।
- প্রশ্ন: তোমার কথায় এই লাইনে আর্থিক নিশ্চয়তা সবার জন্য নয়। ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা সফল, সেখানেও দেখা যায় নায়কদের তুলনায় নায়িকারা কম পারিশ্রমিক পান। এটা কিভাবে দেখো?
মান্নত: ঠিকই বলেছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই শোষণ সর্বত্র। মেয়েদের সাহস করে একসঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত। নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে যতক্ষণ না সব মেয়েরা সচেতন হবে, ততদিন এই শোষণ চলবে।
- প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রি এখনও পুরুষদের হাতে। প্রতিবাদ করলে কাজ হারানোর ভয় থাকে। নায়করা ৬০ বছর বয়সেও নায়ক সাজেন, হাঁটুর বয়সী নায়িকাদের সঙ্গে। সেখানে মেয়েরা প্রকৃতিগত কারণে তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়। তখন মা মাসির চরিত্র ছাড়া উপায় থাকে না। তাই মেয়েরা মুখ বুঝে শোষণের শিকার হয়।
মান্নত: ভুল কিছু বলেননি। তবে একজন শিল্পী নায়িকা হিসেবে কাজ করবেন, ভাববেন কেন? ভালো অভিনেত্রী হওয়া উচিত। সেখানে বয়স ফ্যাক্টর নয়। অভিনয়ের ক্ষমতা থাকলে ঠিক কাজ মিলবে। অবশ্য মহিলা অভিনেত্রীরা সহজে বয়স্ক চরিত্রে কাজ করতে চাননা। তাঁদের এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমিও ভালো অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করতে চাই। শুধু ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে ছোট ছোট জামা পড়ে পুতুল হতে চাই না।
- প্রশ্ন: আজকাল দেখি পরিচালকদের মাথায় কাস্টিং ডিরেক্টর বসানো হচ্ছে? তাঁরাই চরিত্রের বাছাই করেন। কে কি পোশাক পড়বে তাঁরাই ঠিক করছেন।সিরিয়ালে আবার এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার ছড়ি ঘোরান। এঁদের ব্যকগ্রাউন্ড কি?
মান্নত: ঠিকই বলেছেন। আজকাল ব্যাপারটা চালু হয়েছে। এঁরা গল্প বাছেন। এঁরা শিল্পী নির্বাচন করেন। এঁরাই ঠিক করেন সব। এখন টাকার জোরে প্রোডিউসার আসেন বেশিরভাগ। তাঁদের কোনো ধারণা নেই। সব ব্যাপারটাই বাজারি ব্যবসা হিসেবে দেখা হয়। তাই সিনেমার প্রযোজক এঁদের পোষেন।
এঁরা আসলে বেচু বাবু। সাবজেক্ট কতটা ভালো করা যায়, তার চেয়ে বেশি নজর মালটা বিক্রি করতে কি কি করতে হবে। তারা সব বোঝেন। দর্শক কি চায় সব নাকি তাদের নখদর্পণে। তাই কোন পোশাক পড়বো, সেটা পরিচালক নয়, ওঁরা ঠিক করে দেন।এঁদের শিল্প সম্বন্ধে কতটা জ্ঞান আছে তা নিয়েও আমার মনে প্রশ্ন জাগে। কাস্টিং ডিরেক্টররা গল্পটাও জানেন না। উনি খালি দেখবেন,বাজারে বিক্রি কি করে করা যায়। আমি এই বিষয়টাতে বিশ্বাস না করলেও উপায় নেই। দেখবেন, ও টি টি প্ল্যাটফর্মে ওয়েব সিরিজে দারুন কনটেন্ট এর ছবি হচ্ছে।সেখানে কত নামী দামী অভিনেতা কাজ করছেন, সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। আজকাল তাই বাধ্য হয়ে বড় পর্দা ছেড়ে ওঁরাও টি টি প্ল্যাটফর্মে আসছেন। এখানে নামিদামি শিল্পী নয়,কনটেন্ট প্রধান।
আরো পড়ুন Exclusive Interview Shreelagna Bandyopadhyay: বড়োপর্দায় শ্রীলগ্না
- প্রশ্ন: যদিও আরেকটা ব্যাপার ইদানিং বেশি দেখা যাচ্ছে। মি টু। অনেক অভিনেত্রী বহুদিন পর মিডিয়ার কাছে মুখ খুলছেন পরিচালক, প্রযোজক,কাস্টিং ডিরেক্টর বা সহ অভিনেতার বিরুদ্ধে। এমন কোনো পরিস্থিতিতে কি তোমাকে পড়তে হয়েছে?
মান্নত: হ্যাঁ। আজকাল ব্যাপারটা অনেক বাড়ছে। যা রটে,তার কিছুটা ঘটে তো বটেই। তবে আমি এখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। সাউথের এক প্রোডাকশন হাউজের কাছে একবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি বটে। মুখের ওপর বলে দিয়েছি, আপনি আমাকে কাস্ট করবেন কিনা এটা যেমন আপনার ইচ্ছে, তেমন আপনার শর্তে আমি কাজ করবো কিনা সেটাও আমার ইচ্ছে। তবে কি জানেন, এই এক্সপ্লয়টেশন শুধু যে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে হচ্ছে তা নয়। কর্পোরেট জগতে, রাজনীতিতে সব জায়গায় হচ্ছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বদনাম বেশি। অথচ এখানে কিন্তু জোর করে কাউকে বাধ্য করা হয় না। কেউ কাউকে পটিয়ে নিলে আলাদা কথা। কেউ জোর করে ইন্ডাস্ট্রিতে বাধ্য করে না। তবে কেউ কেউ দ্রুত আর্থিক স্বচ্ছলতা পেতে চান। সহজেই তারা বিকিয়ে যান।তাদের কথা আলাদা। চাকরি ক্ষেত্রে চাকরি যাওয়ার ভয় থাকে। প্রমোশন না হওয়ার ভীতি থাকে। হ্যাঁ। এখানেও কাজ না মেলার ঝুঁকি থাকে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা থাকবে। সুতরাং কে কোন শর্তে কম্প্রোমাইজ করবে, সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্বান্ত। অনেকে আছেন, তাড়াতাড়ি সাফল্য পেতে কম্প্রমাইজ করে ফেলেন এই দুনিয়ায় আসতে না আসতেই। এরা নিজেদের ক্ষতি তো করেনই, আমাদের মত শিল্পীদেরও বদনাম করেন।তবে নিজের যোগ্যতার ওপর যদি আস্থা থাকে, সে সফল হবেই। জ্যাকলিন ফার্নান্দেজ কেউ কেউ হতে চান। আবার কেউ বিদ্যা বালান। মনে আছে, বদলাপুর ছবির কথা। একটি রেপড মেয়ের চরিত্রে বিদ্যা কি দারুন অভিনয় করেছিলেন। আমার আদর্শ বিদ্যা বালানের মত অভিনেত্রী। তবে ভাগ্যটা ও একটা বড় ফ্যাক্টর।
- প্রশ্ন: অভিনয়, নাচ,এখন জুরি। সবই সময়সাপেক্ষ কাজ।সামলান কি করে?
মান্নত: সবটাই টাইম ম্যানে। ইচ্ছে আর নিষ্ঠা থাকলে সব হয়। আমি তো বলবো, আজকের প্রজন্ম বিনোদন জগতে পা ফেলার আগে যেন ভেবে নেন, তিনি কতটা যোগ্য। লড়াই করার মতো ধৈর্য ও সাহস আছে কিনা। গ্ল্যামার দেখে চলে আসা ভুল। মোটামুটি স্ট্রাগল করার জন্য জীবনের পাঁচটা বছর নিয়ে জুয়া খেলা যায়। এর বেশি নয়। জীবনের পনেরোটা বছর আমরা খরচ করি পড়াশুনো করতে। সেটা কেউ কাজে লাগাতে পারি। কেউ পারি না। তবু সবাই পড়াশুনোকরে। তেমন ভালো অভিনেতা হতে পারবেন কিনা , সফল হবেন কিনা সেটা দেখার জন্য খুব বেশি হলে পাঁচ বছর দেখা যেতে পারে। সফল না হলে অন্য কিছু ভাবা উচিত। নাহলে দুদিকই যাবে। শেষ পর্যন্ত বিনোদন জগতে কাজ পেলেও একটা দ্বিতীয় রোজগারের ব্যবস্থাও ভেবে রাখা দরকার।কেননা এই লাইনে ভরসা নেই।
- প্রশ্ন: তাহলে একটা ক্যালকুলেটর নিয়ে ঘোরা উচিত?
মান্নত: (হেসে)অবশ্যই। আমি যখন ব্যবসাও করি, ওটা তো রাখা দরকারই।
- প্রশ্ন: প্রিয় অভিনেত্রী কে?
মান্নত: যদি পুরানো দিনের কথা বলেন, বলবো সায়রা বানু। আর যদি এখনকার কথা বলেন, বলবো প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথা। তিনি প্রমাণ করেছেন হলিউডে শুধু সেক্স ইমেজ দিয়ে নয়, অভিনয় করেই কাজ পাওয়া যায়। সেই প্রথম। তারপর মল্লিকা সরওয়াত যদিও জ্যাকি চ্যানের সঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু সেখানে অভিনয়ের চেয়ে লাস্যময়ীর প্রয়োজন ছিল বেশি । দীপিকা পাড়ুকোন ,আলিয়া ভাট শুধু অভিনয়ের ক্ষমতা দিয়েই হলিউডে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু প্রথম পথ দেখান প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। অভিনয়টা আসলে অন্যের জন্য নয়। নিজের জন্যই করছি, এমন ভাবতে হবে। রোজ কিছু না কিছু শেখার আছে। আমিও রোজ শিখি।
- প্রশ্ন: কিন্তু এখনও তো বলিউডে নায়কদের পারিশ্রমিক অনেক বেশি নায়িকাদের তুলনায়।
মান্নত: একথা সত্যি। আসলে অভিনেত্রীরা যতদিন না এসবের বিরুদ্ধে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াবেন ,ততদিন কিছু হবে না।
- প্রশ্ন: কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে তো লবি বলে একটা জিনিষ আছে।bনতুন নতুন নায়িকা আসছে। কে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়? কাজ না পেতে পেতে বয়স বেড়ে যাবে, শেষে মায়ের চরিত্রে কাজ করতে হবে।
মান্নত: জাত অভিনেত্রী নায়িকা হিসেবে নয়, অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা চান। তবে এমন ব্যাপার যে আছে অস্বীকার করি কীকরে?
- প্রশ্ন: এত স্ট্রাগল ছোট থেকে মাঝে মাঝে মনে হয় না লড়াইতে যদি একটা ভালো বন্ধু থাকতো,,, আগে নায়িকারা ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে বিয়ে করতেন। অবশ্য শর্মিলা ঠাকুর, ডিম্পল অনেক ছোট বয়সে বিয়ে করেন। এখন দেখছি,বাংলা বা বলিউডে অল্প বয়সেই বিয়ে করে নিচ্ছেন। তুমি কি করবে?
মান্নত: দেখুন,আমার অনেক ছেলে বন্ধু আছে।
- প্রশ্ন : আমি শুধু বন্ধুর কথা বলছি না। তোমার জীবনে কোনও মেল এক্সপ্রেস ট্রেন কি মান্নত স্টেশনে দাঁড়িয়েছে?
মান্নত: বুঝেছি, আপনি কি ইঙ্গিত করছেন। কিন্তু এখন আমাকে অনেকটাই পথ চলতে হবে। আগে থেকে প্ল্যান করে এসব হয় না। তেমন যদি কেউ আসে দেখা যাবে।
- প্রশ্ন: তাঁকে কি পাঞ্জাবি হতে হবে? নাকি মুম্বাই ছোড়া? নাকি কোনও বাঙালি বাবু?
মান্নত: এতসব ভাবিনি। একাকিত্ব কখনও ফিল করিনি। আমি বই পড়তে ভালবাসি। গান শুনতে ভালোবাসি। নাচ আর অভিনয় নিয়ে ভালই আছি। আসলে জীবনসঙ্গী এমন হওয়া উচিত, যে আমাকে বুঝবে। সম্মান করবে মানুষ হিসেবে।বন্ধু হিসেবে। আমি যেমন তাঁকে,, তাঁর পরিবারকে বুঝবো, সেও যেন আমাকে, আমার বোনদের, আমার মাকে বুঝবে। বিয়ের প্রথম চার বছর প্রেম একদম চিপকে থাকে। তারপর বাকি জীবনটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার। সেটাতেই আমার বিশ্বাস। আমার ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা আমাকে বয়সের অনেক আগে পরিণত করে দিয়েছে।
- প্রশ্ন: তাহলে এখনই বিয়ের কথা ভাবছ না?
মান্নত: এখনতো বড়ই ব্যস্ত। প্রেমের ফাঁদে জড়াতে চাই না। যদি জীবনে কেউ আসে, অন্তত একবছর লিভ ইনে থেকে বুঝবো, দুজনে দুজনের কাছে কতটা বিশ্বস্ত।
- প্রশ্ন: কনট্র্যাক্ট?
মান্নত: তা কেন? একটা বোঝার ব্যাপার তো থাকবে?
- প্রশ্ন: একটু আগে তুমি বলেছ, রোজ তুমি কিছু শেখ।এখনতো কলকাতায় এসেছো শিখতে নয়, শেখাতে। দি গোল্ডেন গার্ল রিয়েলিটি শো’ র অডিশন নিতে। কলকাতায় অডিশন কেমন হলো?
মান্নত: বাংলায় অনেক ট্যালেন্ট। দরকার গ্রুমিং। প্রচুর মেয়ে অডিশন দিয়েছে । আমি সবাইকে বলেছি, রিয়েলিটি শো মানে রি টেকের সুযোগ নেই। স্ক্রিপ্ট নেই। যেটা করবে, একবারই সুযোগ পাবে। শো তে নিজের ম্যানারিজম দেখাতে হবে। যেটা নিজস্ব। অভিনয়, নাচের বাইরে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সাইকোলজিকাল টেস্টও প্রাধান্য পাবে। পুরো শিল্পী সত্ত্বা প্রকাশ করার সুযোগ থাকছে। আমরা পাঁচজন মহিলা জুরি থাকবো। আমাদের মধ্যেও যে মতের মিল হবে তা নয়।bহয়তো আমাদের মধ্যেও তিক্ততা হবে। যদি বলছি কেন,হবেই পাঁচটা মেয়ে থাকবে ,
আর সব কিছু ঠিকঠাক চলবে,হতেই পারে না।
- প্রশ্ন: তাহলে রিয়েলিটি শো’ র পরিচালক অবিনাশ রাউত একা আপনাদের সামলাবেন কি করে?
মান্নত ( হেসে গড়িয়ে পড়ে) সেটা একটা প্রশ্ন বটে, আমাদের মেয়েদের ভিড়ে পরিচালক বেচারি একা পুরুষ। বেশ চাপে থাকবেন।( আবার হাসি)।
- প্রশ্ন: আচ্ছা,হায়দরাবাদ বাদে সব জায়গায় অডিশন শেষ। কলকাতাকে কত নম্বর দেবে?
মান্নত: দেখুন এখন পর্যন্ত বহু মেয়ে অডিশনে চান্স পেলেও আমার চোখে মাত্র ৭/৮জনই ধরা পড়েছে।যাঁদের মধ্যে টোটালিটি পেয়েছি। আসলে পারফরমেন্সে সিনেমায় ১৯/২০ চলে। কিন্তু রিয়েলিটি শোতে ১ টি পয়েন্ট অনেক মূল্যবান।
আরো পড়ুন Exclusive Interview: স্টার জলসার ‘খুকুমনি হোমডেলিভারি’র Nayanika Sarkar
- প্রশ্ন: ও টি টি প্ল্যাটফর্মে এই প্রথম রিয়েলিটি শো।তোমার কোনো হাতে কলমে অভিজ্ঞতা নেই।পরিচালকের নেই। অন্য জুরিদেরও নেই। অফারটা যখন এলো, কি ভাবলে?
মান্নত: কিছুই ভাবি নি। রিয়েলিটি শো ব্যাপারটা তো এক। খালি প্ল্যাটফর্ম আলাদা।
- প্রশ্ন: কলকাতার প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন?
মান্নত: দুর্দান্ত। এখনকার মানুষ কিউট। সংস্কৃতিবান।রুচিসম্পন্ন। দেশের অন্য জায়গায় রাতে মেয়েদের বেরোনোর একটা সমস্যা আছে। কিন্তু এখানে হোটেলে ডিনার সেরে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরেছি রাত ১১টা নাগাদ। রাস্তায় পুলিশের পেট্রোলিং। মনে হয়েছে আমি কলকাতায় নয়, মুম্বাইতে আছি। এটা আমার সেকেন্ড হোমটাউন মনে হয়েছে।
- প্রশ্ন: কাজের ফাঁকে কলকাতা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে?
মান্নত: না। খালি সাইন্স সিটি আর ভিক্টোরিয়া দেখেছি। আমি আসলে ঘুমুতে ভালোবাসি ।
- প্রশ্ন: ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে। জ্যোতিষে বিশ্বাস আছে। কোনো মন্দিরে যাওনি?
মান্নত: হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলতে ভুলে গেছি। আমি হোলির দিন কলকাতায় আসি। সেদিন ছিল পূর্ণিমা।কালীঘাটে গিয়ে মাকে প্রণাম করে এসেছি। তাঁর আশীর্বাদ নিয়েছি।
- প্রশ্ন: বাংলা ছবির ডাক পেলে করবে?
মান্নত: নিশ্চয়ই। সিনেমার দুনিয়ায় বাংলায় কাজ করাটা ভাগ্যের। সামনের বার যখন কলকাতায় আসবো, দেখবেন কত ভালো আমি বাংলা বলছি।
আর বেশিক্ষণ মান্নতকে আটকানো সমীচীন মনে হয়নি। হায়দ্রাবাদের ফ্লাইট ধরার সময় হয়ে গেছে।সাক্ষাৎকার শেষে সঙ্গী ফটো জার্নালিস্ট বিশ্বজিত সাহা মান্নতের বিভিন্ন মুডের কিছু ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। হাসিমুখে মান্নত বিশ্বজিতের সব আবদার মিটিয়ে বিদায় নিল তৈরি হবে বলে। দি গোল্ডেন গার্ল ও টি টি প্ল্যাটফর্মে দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম রিয়েলিটি শো ‘ হায়দরাবাদ অডিশন পর্বের জন্য যাত্রা। শুভ কামনা জানিয়ে যখন হোটেল ছাড়লাম,পশ্চিমে সূর্য তখন গুডবাই জানাচ্ছে সেদিনের মত।
Discussion about this post