পৃথা মন্ডল: চকলেট খেতে আমরা কে না পছন্দ করি না। বাচ্চা থেকে বয়স্ক প্রায় সকলেই চকলেটে আকৃষ্ট হয়। সকলেরই কমবেশি চকলেট প্রিয়। যেমন ছোট্ট শিশুটি চকলেট পেলে কান্না থামিয়ে চকলেটে মনোনিবেশ করে ঠিক তেমনভাবেই অভিমানী প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে দেরি করে আসা প্রেমিকটা প্যাকেট প্যাকেট চকলেট প্রিয়তমার সামনে হাজির করে, অভিমানটাও চকলেটের মতোই গলে জল হয়ে যায়। আবার কোথাও কোনো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বা কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে পার্টির দেদার উল্লাসে ডেসার্টে চকলেটে মজে উঠেছেন কেউ কেউ। এমনকি ডায়াবেটিসে ভোগা দাদু- ঠাম্মিরাও রাতে ফ্রিজ খুলে লুকিয়ে চকলেটের আনন্দে মজলিস হয়।
আরো পড়ুন বিচ্ছেদের দিন কয়েকের মাথায় সৌম্যর সাথে দেবলীনার নতুন প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন
হ্যাঁ আমরা সকলেই চকলেট খেতে পছন্দ করি। এখানে এই প্রবাদটা বড্ড মানানসই, আট থেকে আশি সকলেই চকলেট ভালোবাসি। কিন্তু আমরা কি কেউ জানি এই চকলেট আসছে কোথা থেকে? কীভাবে তৈরী হয় এই চকলেট? এই ডার্ক চকলেটের ইতিহাস কী? যদি এই ইতিহাস জানতে চান তাহলে আপনাদের থাকতে আমার এই লেখার শেষ পযর্ন্ত। আমার সাথে আপনাদেরও যেতে হবে সাত সমুদ্র পাড় করে ডার্ক চকলেটের সন্ধানে। হ্যাঁ ওই সাত সমুদ্রের পাড়েই আছে আমার আপনার সকলের প্রিয় ডার্ক চকলেটের সন্ধান। সেখানেই লুকিয়ে আছে চকলেটের অজানা ইতিহাস, রহস্য।ডার্ক চকলেটের গন্ধটা খুব ভালো লাগে তাই না? হ্যাঁ চকলেটের মিষ্টি গন্ধটা আমাদের খুব প্রিয়। কিন্তু এই চকলেটের গন্ধে অ্যালির বমি পায়, তাই অ্যালি পালাচ্ছে চকলেট ছেড়ে, অনেক দূরে পালাচ্ছে অ্যালি চকলেটের থেকে।
ভাবতে অবাক লাগছে তাই তো? ভাবছেন এই অ্যালি কে? কেনই বা চকলেটের গন্ধে বমি পায় অ্যালির? আর কেনই বা সে চকলেট থেকে দূরে পালাচ্ছে? তাহলে আসুন অ্যালির পরিচয়টা খুঁজে বের করা যাক, : অ্যালির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। আফ্রিকার মালি (Mali) পৃথিবীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশের মধ্যে একটা ( মালি সম্পর্কে আলোচনা না হয় অন্য একদিন করা যাবে )। অ্যালির বাড়ি এই মালিতে, রাত্রে আগুনের পাশে বসে ঠাকুরদাদার কাছে গল্প শুনতো অ্যালি। দৈত্যের গল্প, যাদের বসবাস ওই উওরের জঙ্গলে। বাচ্চা দেখলেই তারা রক্ত চুষে পুতুল বানিয়ে দেয়। বাচ্চাদের পরিবারের কাছ থেকে তুলে নিয়ে চলে যায় এই দৈত্যেরা। এই গল্প শুনে খুব ভয় পেত অ্যালি পাছে তাকেও ওই দৈত্যের কবলে না পরতে হয়। কিন্তু তাই হল, অ্যালিকেও একদিন ওই দৈত্যেরা তুলে নিয়ে চলে গেল সামান্য 80 (আশি) ডলারের বিনিময়ে।
না অ্যালি আর পালাতে পারবে না কোনোদিন এই দৈত্যেদের হাত থেকে, ঠিক যেমন পালাতে পারবে না 1.8 মিলিয়ন আফ্রিকান শিশু, ঠিক তেমনভাবেই অ্যালিও আর পালাতে পারবে না কোনোদিন। অ্যালিও এই শিশুদের মধ্যে একজন যারা তাদের শৈশবটাকে চকলেটের র্যাপিং পেপারে মুড়ে আমার – আপনার বাচ্চার শৈশবকে সুন্দর করে তুলেছে।পশ্চিম আফ্রিকার দুটি দেশ আইভরি কোষ্ট( ivory coast), আর ঘানা ( Ghana ) এই দুটি দেশ পৃথিবীর মোট কোকোর 70% উৎপাদন করে থাকে। কোকো উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে আইভরি কোষ্ট এবং বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঘানা। কালো মানুষ, কালো মাটি, কালো চকলেট Dark chocolate সবটাই রহস্যের ঘেরাটোপে আবদ্ধ।
আইভরি, ঘানার কোকো ফার্মগুলিতে রোজ হাজার হাজার বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় ফার্মে কাজ করানোর জন্য। এককথায় যাকে বলে শিশু পাচার করা হয়। আর এই ছোট ছোট শিশুদের বেশিরভাগটাই আসে মালি, বুরকিনা, ফাসো প্রভৃতি এইসকল পিছিয়ে পড়া দেশগুলি থেকে। স্কুলে পড়ানো, ভালো কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, ডলারের লোভ দেখিয়ে, কিংবা রাস্তা থেকে জোরজবরদস্তি তুলে নিয়ে আসা হয় এই বাচ্চাদেরকে। আর তারপর শুরু হয় তীব্র নরক যন্ত্রণা। অমানুষিকভাবে পরিশ্রম করানো হয় বাচ্চাগুলোকে দিয়ে, সকাল ছটা থেকে রাত নটা পযর্ন্ত হাড়ভাঙা খাটুনির পরে শিশুগুলোর কপালে খাদ্য হিসাবে জোটে সস্তার ভুট্টা সিদ্ধ আর কলা। তারপর রাত্রে তাদের জানোয়ারের মতো ফেলে রাখা হয় জানালা দরজাহীন কাঠের আস্তাবলে। কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করে তাহলে তাদের কপালে জোটে বেধড়ক মার। এমনকি মার খাওয়ার ফলে অনেক শিশুর মৃত্যুও হয়।
এই কোকো ফার্মের শিশুশ্রমিকদের 40% হল মেয়ে শ্রমিক। এই মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি হয়, বয়সন্ধি আসে এমনকি যৌবনও আসে এই কোকো ফার্মেই। মালিক, ঠিকাদার, সুপারভাইজার, পুলিশ এমনকি মজুরদেরও যৌনতৃপ্তি মেটায় এই মেয়েদের দিয়েই। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে যৌনরোগও। এগারো – বারো বছর বয়সেই গর্ভবতী হয়ে যায় মেয়েরা, পচে গলে নষ্ট হয়ে যায় শৈশব, স্বপ্নে সব বিষাক্ত ভয়ংকর পোকা আসে যা খুবলে খায় শৈশবী হৃদয়, চকলেটি হৃদয়। বেধড়ক মারধর বা ধর্ষণের ফলে যেসব শিশুদের মৃত্যু হয় তাদের নদীতে বা কুকুরের মুখে ফেলে দেওয়া হয়।এই কোকো ফার্মে আসা অধিকাংশ শিশুরাই সারাজীবনে তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারেনা। এখানে আসা সহজ কিন্তু এখান থেকে যাওয়া কঠিন না অসম্ভব।
আরো পড়ুন Exclusive Interview: স্টার জলসার ‘খুকুমনি হোমডেলিভারি’র Nayanika Sarkar
কী ঘৃণ্য লাগছে সবকিছু? ভাবছেন এটাও কীভাবে সম্ভব! হ্যাঁ এটাও সম্ভব। এই স্যোশাল মিডিয়ার দুনিয়ায়, এই ফেসবুকের যুগে, এই আধুনিকতার যুগে এখোনো ক্রিতদাস প্রথা জাগ্রত, তাও সেটা সর্বসমক্ষে। এই ছোট ছোট শিশুগুলোর উপর হওয়া নির্যাতন, তাদের শরীরে আঘাতের এক একটা ক্ষত আর সেই ক্ষত থেকে নিঃসৃত হওয়া রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে তৈরী হয় ডার্ক চকলেট যা আপনার – আমার ফ্রিজে র্যাপিং পেপারে মুড়ে সুসজ্জিত রয়েছে। এই চকলেট আমার – আপনার কাছে সুখ, আর 1.8 মিলিয়ন আফ্রিকান শিশুর কাছে এটা অভিশাপ।
কষ্ট হচ্ছে? মায়া হচ্ছে? মনের মধ্যে কেমন যেন করছে তাই না? হয়তো আমার – আপনার মনে এই শিশুগুলোর জন্য কষ্ট হবে, মায়া লাগবে, কিন্তু, ইন্টারন্যাশানাল মার্কেটের লেবাররা অকেজো। এখানে কারোর জন্য কোনো মায়া- মমতা, স্নেহ- ভালোবাসা নেই। আছে শুধু নৃশংসতা আর অমানুষিক অত্যাচার।প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোকোর দাম কম রাখার জন্যই বেশিরভাগটাই শিশু শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। কারণ 5 থেকে 12 বছর বয়সী শিশু শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় না। আর তার উপর ছোটো ছোটো বাচ্চারা কোকো বাগানের দুর্গম জায়গায় যেতে পারে, যা একটু বড়ো শ্রমিকরা যেতে পারে না। কোকো বাগানের বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিছের কামড়ে অনেক শিশুর মৃত্যুও হয়। কিন্তু তাতে মালিকের কিছু যায় আসে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোকোর দাম কম রাখাটাই তাদের মূল উদ্যেশ্য। শিশু শ্রমিকদের মৃত্যু হলে মালিকের কিছু যাবে আসবে না কারণ, দারিদ্রতা থাকবে, আর তার সাথে বাচ্চার যোগানও থাকবে। পৃথিবীর নামকরা চকলেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেমন: হার্সেস, নেসলে প্রভৃতি এরা এখানকার এই কোকো ফার্মগুলি থেকে কোকো কেনে। সস্তায় কোকো পাওয়ার জন্য এরা চুপ করে থাকবে, কেউ কোনো কথা বলবে না। সবাই সব জেনেও চুপ থাকবে। আর আমরাও মজে থাকবো সুস্বাদু বিদেশি চকলেটের স্বাদে। তার সাথে আমাদের চোখদুটো বন্ধ করে রাখা থাকবে সুস্বাদু ডার্ক চকলেটের র্যাপিং পেপার দিয়ে।
আর কাজের নমুনা জানতে চান? জানতে চান কীভাবে কোকো বিনগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয়? তাহলে আসুন :-
ম্যাশোটি হল এমন এক ধরনের ছুরি যা চালালে মাত্র কয়েক মিনিটে একটি শিশুকে টুকরো টুকরো করে কিমা বানিয়ে দেওয়া যাবে। এই ম্যাশোটি বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, কোকো বিন কেটে, পেড়ে এনে তা ঝাড়াই বাছাই করার জন্য। এই ম্যাশোটির ধারালো কোপে ক্ষতবীক্ষত হয় শিশু শরীর গভীর ক্ষত। 10 বছরের বাচ্চার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয় 100 কেজির কোকো বিনের বস্তা, তা মাথায় নিয়ে চলতে হয় তাদের। একটু বিশ্রাম নিতে বসলেই পিঠে পড়ে চাবুকের বারি, শিকার হতে হয় অমানুষিক অত্যাচারের।হ্যাঁ। এই যুগেই ঘটে চলেছে মধ্যযুগীয় ক্রিতদাস প্রথা। আমার – আপনার আমাদের সকলের প্রিয় ডার্ক চকলেটের উৎপত্তি এই অন্ধকার জগৎ থেকেই। যা সুন্দর সুন্দর র্যাপিং পেপারে মুড়ে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। আর হ্যাঁ অ্যালি কিন্তু কোনোদিন চকলেট খায়নি। চকলেটের স্বাদটাও তার অজানা।
আমি জানিনা অ্যালি পালাতে পেরেছিল কিনা। তবে আমার বিশ্বাস অ্যালি একদিন ঠিক এই অন্ধকার জগৎ থেকে পালিয়ে আসবে মুক্তির জগতে। অ্যালি অনেক দূরে পালাবে; একদিন সে খুব বড়ো মানুষ হবে। আর তার সাথে সাথেই এই অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তি পাবে অ্যালির মতোই 1.8 মিলিয়ন আফ্রিকান শিশুরাও। মুক্তি হবে একদিন খাঁচায় বন্দি প্রজাপতির। তারাও মুক্তির আলোর দিশারী হবে, ফিরে পাবে তাদের হারানো শিশুবেলা পরিবার। একদিন সব অন্ধকার দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে জীবন আলোর মতো হবে সত্যি হবে সব দেখা স্বপ্ন।
Sorce: ড্যানিশ সাংবাদিক মিকি মিস্ত্রাদি। Google or social media…

২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এ সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা এবং ইংলিশ খবর পড়ুন ২৪X৭ নিউজ বেঙ্গল এর ওয়েবসাইটে। নিয়মিত খবরে থাকতে লাইক করুন ফেসবুকে ও ফলো করুন টুইটারে।
‘রঙ’ ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা ‘খাচ্ছে’? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম ‘সংবাদ’! ‘ব্রেকিং’ আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে ‘রঙ’ লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে ‘ফেক’ তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই ‘ফ্রি’ নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।
Discussion about this post